
Now I am become Death,
the destroyer of worlds!
বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরনের পর একজন উদ্ধৃত করেছিলেন এই বাক্যটি। নিউক্লিয়ার ইউপেন কিংবা পারমাণবিক বোমার জনক হিসেবে ইতিহাস যাকে স্বীকৃতি দেয় তার নাম জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ম্যানহাটন প্রকল্পের লস আলামস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির পরিচালক ছিলেন এ মার্কিন ইহুদি নাগরিক। নিজ কাজ কিংবা গবেষণায় আত্মমগ্ন থাকার অভিপ্রায়ে ১৯২০-এর দশকে ওপেনহাইমার নিজেকে বৈশ্বিক বিষয়াবলী থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন, এমনকি সেসময় সংবাদপত্র পাঠ করা কিংবা রেডিও শুনতেন না তিনি। সেই মানুষটিই জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলারের উত্থানের পরপরই রাজনীতিতে আগ্রহী হন এবং পথপরিক্রমায় ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগঠন সহ কমিউনিজম দর্শনে প্রবেশ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন গুজব রটে যায় হিটলার জার্মানীতে পারমাণবিক বোমা বানাচ্ছেন, তখনই আগস্ট ১৯৪২ সালে মার্কিন সামরিক বাহিনী ব্রিটিশ এবং মার্কিন পদার্থবিদদের নিয়ে তারাও পারমাণবিক বোমা বানানোর জন্য এক প্রকল্প চালায় যা পরবর্তীকালে ম্যানহাটন প্রকল্প নামে পরিচিত। এই তুখোড় বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার এর জীবন এবং ম্যানহাটন প্রকল্পের উপর কেন্দ্র করে পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান নির্মাণ করলেন অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র ‘’ওপেনহাইমার’। এবারের অস্কারের আসরের সেরা ছবি, পরিচালক, অভিনেতা, পার্শ্ব অভিনেতা, সংগীত, চিত্রগ্রহণ এবং সম্পাদনার সাতটি পুরস্কার নিজেদের করে নেয় সিনেমাটি।
সমগ্র চলচ্চিত্রটিই ওপেনহাইমার এর প্রোজেক্ট ম্যানহাটন এর ফ্ল্যাশব্যাক এবং রাশিয়ান কমিউনিস্ট এর সাথে তার যোগ থাকার অভিযোগের প্রসিকিউশন এর উপর চলতে থাকে। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণহত্যার কারণ যে ওপেনহাইমার ও তার বিজ্ঞানী দলের আবিস্কৃত অ্যাটম বোমা তা আর আলাদা করে বলে দিতে হয়না। তাইতো খ্যাপাটে ও তুখোড় মেধাবী ওপেনহাইমার তাই আবিস্কারের প্রথমে তৃপ্ততার ঢোক গিললেও শেষটায় অনুশোচনায় মুষড়ে পড়েছিলেন। চলচ্চিত্রটিকে অপেনহাইমারেরে বায়োপিক বলা হলেও এটি সাধারণ বায়োপিক ঘরানার মতো একেবারেই নয়। নির্মাতা ছবিটি নির্মাণ করেছেন অপেনহাইমারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। পুরো পৃথিবী পারমাণবিক বোমার আবিস্কার কিংবা হিরোশিমা, নাগাসাকির বিস্ফোরণ কিভাবে দেখে চলচ্চিত্রটি মোটেও সেরকম দৃষ্টিভঙ্গির নয়। ছবিতে উঠে এসেছে এই পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে গিয়ে বিজ্ঞানী অপেনহাইমারের মনস্তাত্বিক টানাপোড়েন, রাজনীতি পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে নানা টানাপোরেন এর গল্প।
ছবিতে ওপেনহাইমার এর ভূমিকা দারুণভাবে নিভিয়েছেন আইরিশ অভিনেতা কিলিয়ান মার্ফি যিনি পরিচালক নোলানের ইনসেপশন (২০১০) ও ডানকার্ক (২০১৭) চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেন সবচেয়ে আলোচনায় আসেন বিবিসির নাট্যধর্মী ধারাবাহিক পিকি ব্লাইন্ডার্স (২০১৩-২০২২) দিয়ে। দূর্দান্ত ছিলেন আমেরিকার সরকারী কর্মকর্তা লুইস স্ট্রস এর ভূমিকায় রবার্ট ডাউনি জুনিয়র, ইউএস জেনারেল লেসলি গ্রোভস এর ভূমিকায় ম্যাট ডেমন সহ আরও অনেকে। শুধু তাই নয়, ছবিতে ছিলো আলবার্ট আইনস্টাইন, নিলস বোর, এডওয়ার্ড টেলার, আর্নেষ্ট লরেন্স, আইজাক রাবি, হান্স বেটে, রিচার্ড ফাইনম্যান এর মতো ঐতিহাসিক বিজ্ঞানী চরিত্রগুলোও। যারা বিজ্ঞানকে ভালোবাসেন তাদের জন্য ছবিটি নিঃসন্দেহে অন্যরকম আনন্দের উপলক্ষ হবে। ছবিতে দেখানো অপেনহাইমারের সঙ্গে নীলস বোরের প্রথম সাক্ষাৎ, ফাইনম্যানের পাশাপাশি ওপেনহাইমারকে হাঁটতে দেখা, বড়পর্দায় আইনষ্টানকে দেখতে পারার মতো দূর্দান্ত সব ঐতিহাসিক মুহুর্ত আছে ছবিটিতে। শুধু তাই নয়, নন লিনিয়ার স্টোরিটেলিং, দূর্দান্ত চিত্রগ্রহণ, টানটান থ্রিলার দর্শককে রাখবে পুরো তিন ঘন্টা জুড়ে। বড়পর্দায় সাদাকালো এবং রঙ্গিন আবহে দুটি আলাদা সময়কে প্যারালালি নিয়ে আসতে পারার চমক একমাত্র ক্রিষ্টোফার নোলানের পক্ষেই সম্ভব। অনেকে বলে থাকেন, ক্রিষ্টোফার নোলানের চলচ্চিত্র মাথার উপর দিয়ে যার, তাঁর সিনেমা দু-তিন বার না দেখলে বোঝার উপায় নেই! এই ব্যাকরণে অবশ্য ‘ওপেনহাইমার’ কে ফেলা যায়না। বিশ্ব রাজনীতির এই জটিল থেকে জটিলতর বিষয়কে এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সহজে দেখতে শিখিয়েছেন পরিচালক মহাশয়। এছাড়া লুডভিগ গোরানসনের সঙ্গীত চলচ্চিত্রটির অন্যতম শক্তিশালী একটি দিক, সিনেমার মূল থিমটি বেশ কয়েকটি দৃশ্যে প্রভাব ছড়িয়েছে। আর রিচার্ড কিং এর সাউন্ড ডিজাইনও বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে। ওপেনহাইমার দর্শন শেষে দর্শকের মন একধরণের ধাঁধায় আক্রান্ত হবে, মনে কেবল ঘুরপাক খাবে অসংখ্যা প্রশ্ন আর বিভ্রান্তির। যারা ছবিটা দেখেছেন তাদের মধ্যে ছবির চরিত্রগুলোর মধ্যে ‘কে ঠিক, কে বেঠিক’ এই উত্তর খোঁজার দোলাচল কি এখনো কেটেছে! বোধকরি কাটেনি এখনো…
আর্টিকেলটি দৈনিক ভোরের কাগজে পূর্বপ্রকাশিত
লেখকের অনুমতি ছাড়া সাইটে ব্যবহৃত সকল প্রকার লেখা পুনঃপ্রকাশ বেআইনি। জরুরী যোগাযোগে ইমেইলঃ altamishnabil@gmail.com