
হিমালয়ের কোল ঘেঁষে থাকা এক ছোট্ট দেশ, ভুটান, যার সৌন্দর্য, সংস্কৃতি ও আত্মিক পরিবেশ প্রতিটি ভ্রমণপ্রেমীর হৃদয়ে গভীরভাবে ছাপ ফেলে। সারা বিশ্ব যখন কোলাহলে মুখর, তখন ভুটান যেন এক শান্তির দ্বীপ, যেখানে প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিকতা পাশাপাশি হাঁটে। সম্প্রতি আমি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ ভুটানের তিনটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান-পারো, থিম্পু এবং পুনাখা ভ্রমণ করেছি। এই ভ্রমণ ছিল শুধুই জায়গা দেখা নয়, বরং আত্মার এক নবজন্ম।
পারো: পাহাড়, প্রাচীনতা ও প্রার্থনার শহর
আমার ভুটান ভ্রমণের শুরু হয়েছিল পারো থেকেই। বিমানবন্দর থেকে বের হতেই চোখে পড়ল চারপাশের পাহাড়ঘেরা উপত্যকা, ঝকঝকে বাতাস ও নীল আকাশ। পারো যেন এক অদ্ভুত সুন্দর, যেখানে প্রকৃতি এবং ইতিহাস হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। তবে বিমানবন্দরে নেমে মনে হলো, এমন নিরিবিলি আর ছোটখাটো এয়ারপোর্ট পৃথিবীর আর অন্য কোথায় আছে কিনা বলা মুস্কিল!
আমাদের প্রথম দর্শনীয় স্থান ছিল তাচোগাং লাহাখাং, এক প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির। এর পাশে রয়েছে একটি ১৫শ শতাব্দীর লোহার ঝুলন্ত সেতু, যা এখনো ব্যবহারযোগ্য। স্থানটি ছিলো পারো ছু কিংবা পারো নদীর কোলঘেষে, যা প্রকৃতির সঙ্গে এক অপূর্ব মিলনের অনুভূতি দেয়। ভুটানের ভাষাত ছু মানে নদী।
পারোর তথাপি সমগ্র ভুটানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থান তাকসাং মনাস্ট্রি বা টাইগারস নেস্ট। এটি একটি প্রাচীন পবিত্র গুহা, যা একটি খাড়া পাহাড়ের গা ঘেঁষে পারো ভ্যালি থেকে প্রায় ৯০০ মিটার এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩,১২০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। গুগলে ভুটান লিখলেই যে ছবি সবার আগে ভেসে আসে সেই স্থান হচ্ছে এই টাইগারস নেস্ট। সমতল ভূমি থেকে এই নেস্টে উঠতে নামতে সবমোট লেগে গেলো পাক্কা ৭ ঘন্টা! এই দু:সাহসিক ট্রাকিং অভিজ্ঞতায় পা আরেকটু হলেই অক্কা পেত, তবে হাল ছাড়িনি। ফলাফল ছিলো সুমধুর!
উপরে ওঠার পথে বাতাসে পাইনগাছের ঘ্রাণ, পাহাড়ি ঝর্ণার শব্দ আর মাঝে মাঝে প্রার্থনার পতাকার শব্দ শুনে মনে হয়েছিল আমি যেন অন্য এক জগতে প্রবেশ করেছি। ১৬৯২ সালে এখানে গুরু পদ্মসম্ভব ধ্যান করেছিলেন বলে এটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। আর ট্রাকিং শেষে অভিজ্ঞতা হয়েছিলো ভুটানের ঐহিত্যবাহীন হট স্টোন বাথ নেবার, যার ভ্রমনের কষ্ট অনেকটাই ভুলিয়ে দিয়েছে।
এছাড়াও এ শহরে ঘুরে দেখা হলো পারো জং, যা ১৬৪৬ সালে নির্মিত এই দুর্গ ভুটানের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যর একটি নিদর্শন। কাঠের সেতু পেরিয়ে মূল দুর্গে প্রবেশ করলে অনুভব করা যায় কতটা দক্ষতা ও সৌন্দর্য দিয়ে এই স্থাপনাটি নির্মিত হয়েছে। ভুটানী ছেলেদের জাতীয় পোষাকের নাম গোহ, মেয়েদের পোষাকের নাম ক্কিরা, যশ্মিন দেশে যদাচরণ হিসেবে সমগ্র পরিবারের একসাথে ভুটানের জাতীয় পোশাক পরে ছবি তোলার অভিজ্ঞতাও ছিল অসাধারণ।

থিম্পু: আধুনিকতা ও আধ্যাত্মিকতার যুগলবন্দি
পারো থেকে প্রায় এক ঘণ্টার পথ থিম্পু, ভুটানের রাজধানী শহর। এখানেই দেখা মিলল বুদ্ধ দর্ডেনমা (ধ্যানরত বসে থাকা) মূর্তির-৫১ মিটার উচ্চতার এই ব্রোঞ্জ নির্মিত মূর্তিটি পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে, যেন পুরো দেশটির অভিভাবক। এটি কেবল ভাস্কর্য নয়, বরং প্রার্থনার এক মূর্ত প্রতীক।
শহরে প্রবেশের পরে ঘুরলাম সিম্পলি ভুটান লাইভ মিউজিয়ামে, যেখানে ভুটানের সংস্কৃতি, পোশাক, ঐতিহ্যবাহী ঘরবাড়ি, খেলা, এবং রান্নার নমুনা পাওয়া যায়। এখানে আমি চেখে দেখলাম ভুটানের বিখ্যাত বাটার চা, অংশ নিলাম ভুটানের জাতীয় খেলা আর্চারিতে। ভাগ্যক্রমে একবার তীর লক্ষ্যভেদ করতে পারতেই যেভাবে আশেপাশের লোকজন নেচে-গেয়ে উঠলো, মনে হলো এ যেন এক প্রাণের উতসব! এছাড়াও ঘুরে দেখা হলো ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চোর্তেন, যা ভুটানের তৃতীয় রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুকের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত।

সন্ধ্যাবেলা পায়ে হেঁটে ঘুরলাম ক্লক টাওয়ার স্কয়ার এলাকাটি, যা থিম্পুর হার্ট অব দ্য সিটি বলা চলে। থিম্পুতে এই রাতে আমি চেখে দেখেছি বিখ্যাত এমা দাতশি! কিঞ্চিৎ ক্যাপসিক্যাম গোত্রের স্থানীয় মরিচ এর সঙ্গে পনির এর মিশ্রণ-এ তৈরি করা হয় এই তরকারী। ভূটানের মানুষের প্রতিবেলা খাবার এর মেন্যুতে যেন লাল কিংবা সাদা চালের ভাত সহযোগে এমা দাৎসি না হলে চলেইনা। জংখা ভাষা এমা মানে মরিচ, দাৎসি মানে পনির। সঙ্গে চেখে দেখা হলো মাশরুম দাৎসি, কেওয়া দাৎসি (আলু দিয়ে তৈরি)। উল্লেখ্য মাশরুম দাৎসির স্বাদ আজীবন মুখে লেগে থাকার মতো, যেখানে একসাথে মাশরুম এবং এমা দাৎসির চেখে দেখা হয়ে যাবে।

পুনাখা: প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ইতিহাসের মিলনস্থল
ভুটান ভ্রমণের তৃতীয় গন্তব্য ছিল পুনাখা। থিম্পু থেকে প্রায় ৪ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম এই ইতিহাসঘেরা শহরে। পথে থামলাম দোচুলা পাসে (৩,০৮৮ মিটার)। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকায় এখান থেকে খালি চোখে দেখলাম বরফে ঢাকা হিমালয় পর্বতমালা, মুগ্ধতায় ছেয়ে গেলো মন আবারো। উল্লেখ্য এই দোচুলা পাসে রয়েছে ১০৮টি চোর্তেন বা স্তুপ, যা যোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত।
পুনাখা শহরে মনে গেঁথে থাকার মতো স্থান হলো পুনাখা জং নামের একটি বিশাল দুর্গ, যা ফো ছু আর মো ছু নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা। ১৬৩৭ সালে নির্মিত এই দুর্গের চারপাশ ঘিরে রয়েছে অপার সৌন্দর্য, প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী ও বৌদ্ধ প্রার্থনার মৃদু ধ্বনি। প্রতিবছর একবার উৎসবের রঙ এ মেতে ওঠে এই জং, যেখানে সারা দেশের মানুষদের সাথে সাথে স্ত্রী-সন্তান সহ অংশ নেয় স্বয়ং ভুটানের পঞ্চম এবং বর্তমান রাজা জিগমে খেসার নামাগিয়েল ওয়াংচুক। এছাড়াও পুনাখায় হেঁটে গেলাম ভুটানের অন্যতম দীর্ঘ সাসপেনশন ব্রিজে যা পুনাখার গ্রামগুলোর মধ্যে সংযোগ তৈরি করে। নদীর উপরে দাঁড়িয়ে থাকা সেতুটি যেন আপনাকে প্রকৃতির সঙ্গে একান্ত সময় কাটানোর সুযোগ দেয়।

এই তিন দিনের ভুটান সফর ছিল আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় একটি অধ্যায়। পারোর পাহাড়, থিম্পুর ব্যস্ততা আর পুনাখার প্রশান্তি আমাকে শিখিয়েছে-ভ্রমণ শুধু জায়গা দেখা নয়, বরং আত্মার ভেতরে এক নতুন আলো জ্বালানোর নাম।
ভুটান আমাদের শেখায় ধীরতা, সংযম আর প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের শিল্প। এটি এমন একটি দেশ, যেখানে জিডিপির চেয়ে ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেশে ফিরেছি কেবল কিছু ছবি নিয়ে নয়, বরং হৃদয়ে অগণিত অনুভব নিয়ে।
বিদায় ভুটান! আবার দেখা হোক, জীবনের কোন এক বেলায়, আরও কিছু সুখী মানুষ আর সুখ খোঁজার প্রত্যয়ে..