লেট দেয়ার বি লাইটঃ দেশের সর্বকালের সেরা ছবি!

জানো ওরা আমার ছেলেটাকে হত্যা করেছে হিরোশিমায়।

ওরা আমার মাকে খুন করেছে জেরুজালেমের রাস্তায়।

আমার বোনটাকে ধর্ষণ করে মেরেছে ওরা আফ্রিকাতে।

আমার বাবাকে মেরেছে বুখেনওয়াল্ডে গুলি করে।

আর আমার ভাই। তাঁকে ওরা ফাঁসে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে। কারণ সে মানুষকে ভীষণ ভালোবাসতো..


বলছিলাম ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ চলচ্চিত্রের সংলাপ। জীবিত অবস্থায় পরিচালক জহির রায়হান যেসব চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষনা দিয়েছিলেন তন্মধে ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ বিশেষভাবে আলোচনার দাবী রাখে। লেট দেয়ার বি লাইট চলচ্চিত্রের কাজ শুরু হলেও মুক্তিযুদ্ধের কারণে সিনেমাটি নির্মাণের কাজ শেষ করা যায়নি।

লেট দেয়ার বি লাইট হতে পারত তাঁর আরেকটি মাইলফলক, দেশের সর্বকালের সেরা ছবি! বাংলাদেশের সবচেয়ে গুণী ও সৃজনশীল চলচ্চিত্রকার হিসেবে জহির রায়হানের অবস্থান নিঃসন্দেহে সব ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে। ১৯৬১ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি চলচ্চিত্রে তাঁর নিজস্বতাঁর স্বাক্ষর রেখেছিলেন। চলচ্চিত্র পরিচালনা কিংবা প্রযোজনা ছাড়াও তিনি উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখেছেন; অংশগ্রহণ করেছেন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সরাসরি প্রতিবাদী ভ‚মিকায়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি ক্যামেরা হাতে চলচ্চিত্রকারদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর কিছু চলচ্চিত্র নান্দনিকতাঁর শিখর স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছে। স্টপ জেনোসাইড, কাঁচের দেয়াল, জীবন থেকে নেয়া এই চলচ্চিত্রগুলো বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণকলার ক্ষেত্রে মাইলফলক হয়ে রয়েছে। আন্তর্জাতিক থেকে শুরু করে আমজনতা পর্যন্ত তাঁর অবাধ বিচরণ। চলচ্চিত্রের কড়া সমালোচক থেকে খেটে খাওয়া মানুষ, শহুরে মধ্যবিত্ত থেকে গ্রামীণ সমাজ, মেলোড্রামা থেকে আন্তর্জাতিক পরিসরে বার্তা পৌঁছে দেওয়া প্রামাণ্যচিত্র-সবকিছুতেই তাঁর অসাধারণ মুনশিয়ানা।

ক্যারিয়ারের পরিণত পর্বে এসে জহির রায়হান আন্তর্জাতিক ক্যানভাসে চলচ্চিত্র বানানোর মনস্থির করেন। ১৯৬৫ সালে এপ্রিলে তিনি ঘোষণা দেন “লেট দেয়ার বি লাইট” নামক চলচ্চিত্রটি নির্মাণের। এরপর নানা সময়ে ছবিটি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। ছবিটি বাংলা, ইংরেজী, উর্দু, রুশ, জার্মান ও চীনা ভাষায় ছবিটি ডাবিং কতে মুক্তি দেয়া হবে বলেও জানা যায়, আরও জানা যায় চলচ্চিত্রটি “নিক্কে ফিল্মস” এর ব্যানারে নির্মিত হবে। তবে নানাবিধ কারণে শ্যুটিং এর কাজ অচিরেই শুরু করা যায়নি। ছবিটির ইংরেজী রুপটি লেখার কথা ছিলো তার অগ্রজ সাংবাদিক-সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার এর। সঙ্গীত পরিচালনার ভার ছিলো বহুদিনের বিশ্বস্ত খান আতাউর রহমানের কাছে।

শেষমেশ ছবিটি নির্মাণের মুখ দেখে ১৯৭০ সালের আগষ্টে এসে। ৭ আগষ্ট ছবির মহরৎ অনুষ্ঠিত হয়ে এফডিসিতে ওইদিনই শুরু হয় ছবির শ্যুটিং। জহির রায়হানের ভাষ্যমতে এতদিন তিনি বানিজ্যের কবলে পড়ে সব ছবিতেই কমবেশী ক্রীতদাসের মত কাজ করেছেন। তবে লেট দেয়ার বি লাইট ছবিটিতে তিনি মুক্ত শিল্পীর মতো একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যাচ্ছেন। ছবির নায়ক তপু চরিত্রে ওমর চিস্তি ও নায়িকা ইভা চরিত্রে অলিভিয়া গোমেজকে নিয়ে সিনেমার কাজ শুরু হয়। এই অলিভিয়া গোমেজ পরবর্তীকালে একমাত্র বাংলাদেশী অভিনেত্রী হিসেবে উত্তর কুমারের বিপরীতে অভিনয় করেন। তবে ১৫ সেপ্টেম্বর নাটকীয়ভাবে নায়কা অলিভিয়া গোমেজকে বাদ দিয়ে তার শ্যালিকা ববিতাকে সেই চরিত্রে দেয়া হয়। এফডিসিতে বড় বড় সেট ফেলে এগিয়ে চলে ছবিটির কাজ। নভেম্বরে শ্যুটিং চলাকালীন জহির রায়হান আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ছবির অভিনেতাদের মধ্যে অন্যান্যরা ছিলেন বনানী চৌধুরী, বকুল চৌধুরী, আমজাদ হোসেন, বিনয় বিশ্বাস, ভিনসেন্ট গোমেজ, মাইকেল পিউরিফিকেশন, বদরুদ্দীন, শহীদুল্লাহ, নজরুল ইসলাম ও প্রমুখ।

লেট দেয়ার বি লাইট-সিনেমার একটি পোষ্টার

১৯৭০ এর জানুয়ারীতে এসে চলচ্চিত্রটির ৩০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়। তবে উত্তাল মার্চে দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলনের ফলে ছবির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তযুদ্ধের সময়কালে জহির রায়হান কলকাতায় অবস্থান করে দেশের পক্ষে অসামান্য সব প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। দেশ বিজয়ের পর জহির রায়হান দেশে ফেরেন। তবে ১৯৭২ এ ৩০ জানুয়ারী নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে নিজেও নিখোঁজ হন। পুরোপুরি থেমে যায় ছবিটির মুক্তির পথ। এরপর পরবর্তী সময়ে নানা উদ্যোগের কথা হলেও ছবিটি আলোর মুখ দেখেনি। 

লেখাটি প্রতিদিনের সংবাদ ঈদ সংখ্যা ২০২৪-এ প্রকাশিত

লেখকের অনুমতি ছাড়া সাইটে ব্যবহৃত সকল প্রকার লেখা পুনঃপ্রকাশ বেআইনি। জরুরী যোগাযোগে ইমেইলঃ altamishnabil@gmail.com

আরো পড়ুন...