“মরক্কোর পথে পথে: রঙ, রূপ আর রহস্যের খোঁজে”

রঙে মোড়া, রহস্যময় ও সংস্কৃতিমণ্ডিত এক দেশ মরক্কো-যেখানে একই সাথে রয়েছে আফ্রিকা, আরব ঐতিহ্য ও ইউরোপীয় ছোঁয়ার অপূর্ব সংমিশ্রণ। সমৃদ্ধ ইতিহাস, রাজকীয় প্রাসাদ, সাহারার ধুলা আর আতিথেয়তার উষ্ণতায় ভরপুর এই দেশটি যেন ভ্রমণপিপাসুদের স্বপ্নপুরী। সম্প্রতি একটি অনন্য অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে পেরেছি আমার মরক্কো সফরে। মূলত আফ্রিকার বৃহত্তম প্রযুক্তি সম্মেলন জাইটেক্স আফ্রিকা ২০২৫-এ অংশগ্রহণ করতেই আমার এই সফর, যা ১৪-১৬ এপ্রিল মারাকেশ শহরে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের গুটি কয়েক প্রতিনিধি হিসেবে আমি এই সম্মেলনে অংশ নিই, যা  আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের এশিয়া-আফ্রিকার আইটি বাজারর ডিজিটাল বিজনেস কোলাবোরেশান এবং স্টার্টআপ কানেক্টিভিটির একটি বড় সূচনা।

মরক্কোর স্টিকার ভিসা পেতে হলে আপনাকে ঢাকায় অবস্থিত মরক্কোর দূতাবাস বা কনস্যুলেটে সরাসরি আবেদন করতে হবে। তবে আন্তর্জাতিক ইভেন্টে অংশ নেবার দরুন আমাদের জন্য নিয়মটা অনেকটাই শিথীল ছিলো, আমরা চলে গেছি অনলাইনে আবেদন এর মাধ্যমে ই-ভিসা সংগ্রহ করেই।

চলুন দেখে নেই যা যা দেখা হলো সমৃদ্ধ এই দেশে। 

মারাকেশ – লাল শহরের ছোঁয়া

মরক্কোর প্রাণকেন্দ্র মারাকেশ, যাকে আরবরা বলে মারাক্স বলে। মরক্কোর অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহাসিক শহর, যাকে তার লালচে মাটির দেয়াল ও স্থাপত্যের জন্য বলা হয় “লাল শহর”। এই শহর যেন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও রঙের এক মোহময় সংমিশ্রণ।

যা যা দেখেছি:

কুতুবিয়া মসজিদ: ১২শ শতাব্দীতে নির্মিত এই মসজিদটি মারাকেশের সবচেয়ে বিখ্যাত নিদর্শন। এর মিনার শহরের প্রায় সবদিক থেকে দৃশ্যমান। বর্তমানে এর সংস্কারকার্য চলায় ভেতরে ঢোকার সৌভাগ্য হয়নি।

মদিনা ও জামা আল ফেনা স্কয়ার: পুরনো শহরের প্রাণকেন্দ্র। সাপুড়ে, বংশীবাদক, নানা রকমের ফল বিক্রেতা আর পথশিল্পীদের মিলনমেলা এই স্কয়ারে আরও রয়েছে হরেক রকম রেস্তোরা আর সুভিনিউর দোকানের সম্ভার।

মাদ্রাসা বেন ইউসুফ: একসময়কার ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্রটি এখন পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত, এর আরবি-ক্যালিগ্রাফি এবং মার্বেল কারুকাজ নজরকাড়া। ১৪শ শতকে ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

মারাকেশ মিউজিয়াম ও ফটোগ্রাফি মিউজিয়াম: মরক্কোর শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক ছবি সম্বলিত এই দুটি জাদুঘর সময়ের চাকা ঘুরিয়ে দেয়।

লে জার্দিন সিক্রেট: লে জার্দিন সিক্রেট মারাকেশের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এক শান্ত ও নিভৃত পার্সিয়ান বাগান, যা শতাব্দী প্রাচীন রাজপ্রাসাদের অংশ ছিল। ঐতিহ্যবাহী ইসলামি ও আন্দালুসিয়ান বাগান নকশা নিয়ে এটি এখন এক জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। কোন এক বিকেলে সময় কাটানোর জন্য দারুণ স্থান হতে পারে এই বাগানটি।

মারাকেশ-র বাগানে: লে জার্দিন সিক্রেট

যা মিস করেছি:

সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে আমি কিছু দর্শনীয় স্থান দেখা থেকে বঞ্চিত হই, যেমন: বাহিয়া প্যালেস, এল বাডি প্যালেস, জার্ডিন মেজোরেলে এবং মুসে ইভ সাঁ লঁরাঁ।

এছাড়া মারাকেশ থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত আগাফি ডেজার্ট ও মরক্কো আটলাস স্টুডিও ঘুরে দেখতে হলে আরও ৩-৪ দিন সময় প্রয়োজন।

ক্যাসাব্লাঙ্কা – সমুদ্রপাড়ের বিস্ময়

মারাকেশের পর আমার গন্তব্য ছিল ক্যাসাব্লাঙ্কা (Casablanca), ইউরোপের ধাঁচে গড়া এক আধুনিক এবং শিল্পনগরী, আবার সমুদ্রঘেঁষা শান্ত শহর।

যা দেখেছি:

হাসান-২ মসজিদ ও জাদুঘর: এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মসজিদ এবং একমাত্র যেখানে অমুসলিমরাও নির্দিষ্ট সময় দর্শন করতে পারেন। আটলান্টিক মহাসাগরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এই স্থাপত্য যেন আধুনিকতা আর ঐতিহ্যের এক মহাজন্ম। এর মিনার উচ্চতা প্রায় ৬০০ ফুট। এই মসজিদটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এর একটি অংশ আটলান্টিক মহাসাগরের পানির ওপর নির্মিত এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যেমন স্বয়ংক্রিয় ছাদ, ভূগর্ভস্থ গ্যারাজ ও তাপ-নিয়ন্ত্রিত প্রার্থনাস্থল এখানে সংযুক্ত। মসজিদটি মরক্কোর রাজা দ্বিতীয় হাসান ১৯৮০-এর দশকে নির্মাণ শুরু করেন এবং এটি ১৯৯৩ সালে উন্মুক্ত হয়।

এখান থেকেই আমি কিনেছি মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন-চেবাকিয়া, ঘোরিবা, বাগরিরা, যা বন্ধু ও পরিবারের জন্য উপহার হিসেবে নিই।

যা মিস করেছি:

ইউনাইটেড নেশনস স্কয়ার দেখতে পারিনি, যদিও এটি ক্যাসাব্লাঙ্কার কেন্দ্রস্থল এবং পরিচিত স্থাপনা।

মরক্কোর স্বাদে ভোজন:

ভিন্ন দেশের খাবার নিয়ে যেমন কৌতূহল, তেমনি থাকে দ্বিধা। তবে মরক্কোতে আমি কিছু স্মরণীয় স্বাদ উপভোগ করেছি।

কুসকুস (Couscous): 

মরক্কোর জাতীয় খাবার হিসেবে গণ্য করা খাদ্যের নাম কুসকুস। এটি সেমোলিনা (সুজি) দিয়ে তৈরি ক্ষুদ্র দানাদার খাবার, যা হালকা ভাপে রান্না করা হয়। এটি সাধারণত মুরগি, গরুর মাংস ও বিভিন্ন রকমের সবজির সাথে পরিবেশন করা হয়। মরক্কোর শুক্রবারের ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে কুসকুস খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কুসকুস (Couscous)

পুদিনা চা:

পুদিনা চা মরক্কোর আতিথেয়তার প্রতীক, যেটি অতিথিদের স্বাগত জানানোর সময় পরিবেশন করা হয়। এটি সবুজ চা, প্রচুর চিনি এবং টাটকা পুদিনা পাতা দিয়ে তৈরি হয়। চা পরিবেশনের সময় পাত্র উঁচু থেকে ঢেলে তাতে ফেনা তৈরি করা হয়। এই চা সুগন্ধি, মিষ্টি এবং সতেজতা প্রদানকারী একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় পানীয়।

মরক্কোর পুদিনা চা (Mint Tea)

তাঞ্জিয়া:

তাঞ্জিয়া মারাকেশ অঞ্চলের জনপ্রিয় একটি মাংসের পদ, যা সাধারণত গরুর মাংস দিয়ে তৈরি হয়। মাংসকে রসুন, জিরা, লেবুর আচার ও জলপাই তেলের সাথে মিশিয়ে মাটির হাঁড়িতে রাখা হয়। তারপর সেটিকে কয়লার আগুনে দীর্ঘ সময় ধরে রান্না করে গভীর স্বাদ তৈরি করা হয়।

শামুক / বাবুচ:

বাবুচ হলো মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী স্ট্রিট ফুড, যেখানে ছোট ছোট শামুক সুগন্ধি মশলা ও হারবাল স্যুপে রান্না করা হয়। এটি বিশেষভাবে ঝাল ও মসলাদার ঝোলের সাথে ছোট কাপ বা বাটিতে পরিবেশন করা হয় এবং টুথপিকের মতো কাঠি দিয়ে খেতে হয়। বাবুচ শুধু খাবার নয়, বরং এটি মরক্কানদের মাঝে স্বাস্থ্যগুণেও পরিচিত। রাস্তাঘাটের দোকানে গরম গরম বাবুচ খাওয়া মরক্কোর এক বিশেষ অভিজ্ঞতা!

তাজিন:

তাজিন হলো এক ধরনের ধীরে রান্না করা মরক্কান খাবার, যাতে মাংস, সবজি ও মশলার সমন্বয় থাকে। এটি বিশেষ আকৃতির একটি মাটির ঢাকনাযুক্ত পাত্রে রান্না করা হয়, যাকে তাজিন পাত্র বলা হয়। এই পাত্রে বাষ্প ধরে রাখার কারণে খাবার হয় নরম, রসালো ও সুগন্ধি। তাজিন পাত্রে রান্না করা এই পদ মরক্কোর রন্ধনশৈলীর অন্যতম প্রতীক।

ব্যক্তি অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, মরক্কোর রন্ধনপ্রণালী আমাদের উপমহাদেশের রান্নার সাথে একদমই আলাদা। তেল-লবন-মশলা কম দিয়ে রান্না যেখানে ওদের নিত্তনৈমিত্তিক বিষয় সেখানে আমাদের এ অঞ্চলে স্বাদ বাড়াতে তেল-মশলার জুড়ি নেই। তাই পুদিনা চা ছাড়া বাকী সব আইটেম মুখে না রুচলে সেই দ্বায়িত্ব লেখকের নয়।

মনে রাখার মতো কেনাকাটা: মরক্কো ঘুরে এসে আমার স্যুভেনির ব্যাগও ভরে গেছে। আমি কিনেছি..

মরক্কান থোব: ঐতিহ্যবাহী লম্বা জামা, যা মরক্কোর সংস্কৃতির প্রতীক।

মরক্কো জাতীয় ফুটবল দলের জার্সি: জার্সির পেছনে প্রিন্ট করা ছিলো মরক্কোর স্টার খেলোয়াড় হাকিমি-এর নাম। এছাড়াই মরক্কোর মোজাইক ডিজাইনে ফ্রিজ ম্যাগনেট-তো ছিলোই।

সময় স্বল্পতায় অনেক কিছু দেখা হয়নি ঠিকই, তবে মরক্কোর রঙিন স্মৃতি, মিন্ট চায়ের সুগন্ধ আর টাঙ্গিয়ার স্বাদ মন থেকে কখনও মুছে যাবে না।

মরক্কো ভ্রমণ ছিল আমার জন্য শুধু কর্মসূত্রে নয়, বরং সংস্কৃতি, ইতিহাস ও জীবনধারার এক চমৎকার জানালা। জাইটেক্স আফ্রিকা ২০২৫-এ অংশগ্রহণ আমার পেশাগত জীবনে যেমন নতুন দিগন্ত খুলেছে, তেমনি মরক্কোর রাস্তাঘাট, খাবার, মানুষের আতিথেয়তা এবং ঐতিহ্য আমাকে অভিভূত করেছে।

মরক্কান টেক উদ্যোক্তা রোকায়া জামালি এবং জেসিআই আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচের কর্মকর্তা বেনিন থেকে পাকোম আমুসু

বলা হয়ে থাকে, পৃথিবী একটি বই, আর যারা ভ্রমণ করে না তারা সেই বইয়ের শুধু একটি পৃষ্ঠাই পড়ে। আপনারাও যদি কখনও মরক্কো যাওয়ার পরিকল্পনা করেন, অন্তত একবার মারাকেশের রাস্তায় সব কাজ ভুলে আনমনে হাঁটুন, জামা এল ফেনা স্কয়ারে স্থানীয়দের সাথে মিশে একটি বর্ণীল সন্ধ্যা কাটান আর হাসান-২ মসজিদের ধারে দাঁড়িয়ে আটলান্টিকের হাওয়া গায়ে মেখে নিন- জীবনটা যে কত বৈচিত্র্যময় তা বুঝে যাবেন। সমস্ত সফরে আমার সঙ্গী ছিলো মরক্কান টেক উদ্যোক্তা রোকায়া জামালি এবং জেসিআই আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচের কর্মকর্তা বেনিন থেকে পাকোম আমুসু, দুজনকেই ধন্যবাদ এমন দারুণ ভ্রমণস্মৃতি উপহার দেবার জন্যে।

লেখাটি প্রতিদিনের বাংলাদেশে পূর্বপ্রকাশিত

লেখকের অনুমতি ছাড়া সাইটে ব্যবহৃত সকল প্রকার লেখা পুনঃপ্রকাশ বেআইনি। জরুরী যোগাযোগে ইমেইলঃ altamishnabil@gmail.com

আরো পড়ুন...